ডায়াবেটিস কি ডায়াবেটিস কেন হয়
ডায়াবেটিস কি ডায়াবেটিস কেন হয়? ডায়াবেটিস হলে কী সমস্যা হতে পারে।
ডায়াবেটিস কি?
আমাদের শরীরে পেটের উপরের অংশে অগ্ন্যাশয় বলে ছোট্ট একটি গ্রন্থি আছে দেখতে অনেকটা পাতার মতো এই অগ্ন্যাশয় থেকে একটা রস নিঃসৃত হয়, যাকে আমরা বলি ইনসুলিন। ইনসুলিন হচ্ছে, একটি হরমোন। এটা আমাদের স্বাভাবিক বিপাক ক্রিয়ার জন্য
অত্যন্ত জরুরি।
আমরা খাবারের মাধ্যমে যে শর্করাজাতীয় খাবার খেয়ে থাকি। যেমন মিষ্টি, ভাত, রুটি, আলু ইত্যাদি। এগুলো হজমের পর আমাদের রক্তে চলে যায় এবং রক্তে চিনি বা গ্লুকোজের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ইনসুলিনের কাজ হচ্ছে এই চিনি বা গ্লুকোজ টাকে শরীরের বিভিন্ন কোষে নিয়ে যাওয়া। যেমন লিভার, মাংসপেশিতে, এবং সেখানে এটি শক্তি বা ক্যালরি উৎপন্ন করে। কোনও কারণে যদি এই ইনসুলিনটি আর নিঃসৃত না হয় অথবা ইনসুলিন টি অ কার্যকরী হয়ে ওঠে তাহলে রক্তে গ্লুকোজ বা চিনির মাত্রা বেড়ে যায়। একে আমরা বলি ডায়াবিটিস।
ডায়াবেটিস কেন হয়?
যখন কোন কারণে আমাদের শরীরে স্থূলতা বেড়ে যায়? দেখা যাচ্ছে, আমাদের মেদ বা ভুঁড়ি হয়, পেট মোটা হয়ে যায়। তখন ইনসুলিন তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে৷ এটা কী ভাবে হয়? আমরা যে খাবার খাই সেই খাবার থেকে শক্তি উৎপন্ন হয়। কোনও কারণে যদি খাদ্য গ্রহণের মাত্রা আমাদের স্বাভাবিক কাজকর্ম বা এক্সারসাইজ এর তুলনায় বেশি হয়। তাহলে যে পরিমাণ খাবার আমরা খাব। শেষ পর্যন্ত এই খাবারটা চর্বি হিসেবে আমাদের শরীরে জমতে থাকবে এবং এই চর্বি যদি পেটে বেশি পরিমাণে জমে তাহলে ইনসুলিনের কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। এটাকে আমরা বলি ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স। যার ফলে শরীরে দেখা যায় গ্লুকোস বা রক্তে চিনির পরিমাণ বেড়ে যায়। চিনির পরিমাণ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেলে তখনই ডায়াবেটিস রোগটি সৃষ্টি হয়। এখন আপনারা বলতে পারেন যে ডায়াবেটিস নিয়ে কেন এত মাতামাতি কেন আমরা ডায়াবিটিসকে এত বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। ডায়াবেটিস হচ্ছে একটি, নীরব খ্যাত রোগ। উপর থেকে আপনি বুঝতে পারবেন না যে আপনার ডায়াবেটিস আছে, কিন্তু ভিতরে ভিতরে আপনাকে নিঃশেষ করে ফেলবে। অনেকটা ঘূণপোকার মতো। কারও যদি ডায়াবিটিস দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ন্ত্রিত থাকে তাহলে রক্তনালীর গায়ে চর্বি জমতে থাকে। চর্বি জমতে জমতে এক সময় গিয়ে রক্ত নালীগুলো ব্লক হয়ে যায়। এই ঘটনাটি যদি আমাদের ব্রেনে ঘটে, তাহলে যেটা হবে সেটা হচ্ছে স্ট্রোক বা প্যারালাইসিস। যদি হার্টে হয় তাহলে হবে হার্ট অ্যাটাক। যদি কিডনিতে হয় কিডনি অকেজো হয়ে যাবে। যদি চোখে হয় দৃষ্টিশক্তি ব্যাহত হবে। এবং যদি পায়ে হয় তাহলে পায়ের আঙুল কেটে ফেলতে হতে পারে। এগুলো সবই হচ্ছে ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত থাকলে তার ভয়াবহ পরিণতি। আবার যদি এরকম হয় যে, ডায়াবেটিস হঠাৎ করে অনেক বেশি হয়ে গেলো। তাহলে শরীর পানিশূন্য হয়ে যায়। রোগীর প্রেশার নেমে যায়, রোগী অজ্ঞান হয়ে যায়, যাকে আমরা বলি ডায়াবিটিক ইমার্জেন্সি এবং এই ক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসা না নিলে এই রোগীকে আর কোনো ভাবেই বাঁচানো সম্ভব হয় না।
ডায়াবেটিস এর লক্ষণ সমূহ
রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা যদি খালি পেটে ৭ মিলি মোল বা তার বেশি থাকে অথবা একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ গ্লুকোজ খাওয়ার ২ ঘণ্টা পরে যদি ১১ মিলি মোল অথবা তার বেশি থাকে তাহলে সেটাকে ডায়াবেটিস বলে ধরা হবে। ডায়াবেটিস আছে, অথচ ব্লাড সুগার খুব বেশি নয়, এই সমস্ত রোগীর সাধারণত কোন লক্ষণ থাকে না। তবে যাদের ব্লাড সুগার অনেক বেশি থাকে, তাদের কিছু লক্ষণ থাকে,যেমন অতিরিক্ত পানি পিপাসা পাওয়া, গলা শুকানো, বারে বারে প্রস্রাব হওয়া, হাতে পায়ে জ্বালাপোড়া করা। হঠাৎ করে ওজন কমে যাওয়া বা ওজন বেড়ে যাওয়া, বিশেষ করে মেদ ভুঁড়ির প্রকোপ দেখা দেওয়া। এগুলো সবই কিন্তু ডায়াবেটিসের লক্ষণ। এক্ষেত্রে আপনি দেরি না করে আপনার চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন। তিনি আপনাকে সঠিক পরামর্শ দিবেন। আবার কখনও কখনও দেখা যায়, রোগী কোন লক্ষণ ছাড়াই ডায়াবেটিসের জটিলতা সম্পর্কিত রোগ, যেমন স্ট্রোক,হার্ট অ্যাটাক, পেরিফেল ভাস্কুলার ডিজিজ বা পায়ে গ্যাংগ্রিন এই ধরনের সমস্যা হতে পারে। ডায়াবেটিক রোগী সাধারণত, সংক্রামক ব্যাধিতে বেশি পরিমাণে আক্রান্ত হয়। ফলে কোনও ইনফেকশন হলে, সহজে গা শুকায়না, এবং সেটা অনেকদিন থাকে। অথবা ডায়াবিটিসের কিছু আরিজুয়া প্রেজেন্টেশন রয়েছে, যেমন বাচ্চা না হওয়া, মিসক্যারেজ বা গর্ভপাত। শরীরে ঘা না শুকানো। সামান্য পরিশ্রমে হাঁপিয়ে ওঠা, ইত্যাদি।
ডায়াবেটিস এর সাভাবিক মাত্রা কতো?
ডায়াবেটিস নিয়ে আমরা যতটা যানি যে, ডায়াবেটিস কি? কেনো হয়? হলে কি করতে হবে? কিন্তু সুগার কতো হলে ডায়াবেটিস, সেটা নিয়ে কনফিউজড হয়ে যাই। বিশেষ করে, কোনটা প্রি–ডায়াবেটিস স্টেজ? কোনটা ডায়াবেটিস স্টেজ? এটা পরিস্কারভাবে জানা জরুরী। তাহলে ৩ টি স্টেজে সুগারের মাত্রাগুলো নিয়ে আলোচনা করি। (১) নরমাল ব্লাড সুগার, খালি পেটে <৫.৬ মিলি.মোল এর নিচে থাকলে এবং খাবারের ২ ঘন্টা পারে ব্লাড সুগার <৭.৮ এর নিচে থাকলে, এটাকে বলে নরমাল ব্লাড সুগার। (২) প্রি–ডায়াবেটিস ব্লাড সুগার, খালি পেটে যখনই ব্লাড সুগার ৫.৬ থেকে ৬.৯ মিলি.মোল হয়ে যায় এবং খাবারের ২ ঘন্টা পরে ৭.৮ থেকে ১১.১ হয়ে যায় তখন এটাকে বলে প্রি–ডায়াবেটিস ব্লাড সুগার । (৩) ডায়াবেটিস ব্লাড সুগার, খালি পেটে যখনি ব্লাড সুগার >=৭ মিলি.মোল এর উপরে চলে যাচ্ছে এবং খাবারের ২ ঘন্টা পরে ব্লাড সুগার >=১১.১ এর উপরে চলে যাচ্ছে, তখন পরিস্কারভাবে এটাকে ডায়াবেটিস বলে। তারপর আসি রেন্ডম ব্লাড সুগার, রেন্ডম ব্লাড সুগার লেভেল ৪.৪ থেকে ৭.৮ মিলি.মোল হলে, এটা নরমাল। আবার যদি ৭.৮ থেকে ১১.১ মিলি.মোল হয়, তাহলে এটা প্রি–ডায়াবেটিস এবং >=১১.১ মিলি.মোল এর উপরে চলে গেলে এটা ডায়াবেটিস। সবশেষে হিমোগ্লোবিনA1C, এটা যদি <৫.৭ এর কম থাকে, তাহলে এটা নরমাল স্টেজ। আর যদি ৫.৭ থেকে ৬.৪ মধ্যে হয়, তাহলে এটা প্রি–ডায়াবেটিস স্টেজ। এবং >=৬.৫ এর উপরে হলে এটাকে বলা হয় ডায়াবেটিস।
ডায়াবেটিস সচেতনতায় করনীয় কি?
আমাদের সামান্য একটু সচেতনতা থাকলেই আমরা এই মারাত্মক রোগের হাত থেকে রক্ষা পেতে পারি। এমনকী কারও যদি এই রোগটি ধরা পড়ে, তাহলে সামান্য কিছু নিয়ম কানুন মেনে চললে, রেগুলার ডাক্তার দেখালে সম্পূর্ণ নিরাপদ সুস্থ জীবনযাপন করতে পারেন। প্রথম কথা যেটা, সেটা হচ্ছে আমাদের ওজন অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে রাখতে হবে। সেটা কী ভাবে করা যায়, সেটা হচ্ছে আমাদের খাদ্য গ্রহণ এবং আমাদের এক্সারসাইজ বা ব্যায়াম এর মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। অনেক সময়ে দেখা যায় বাবা মা উভয়েরই ডায়াবেটিস। কিন্তু তাঁরা বাচ্চাদের খেয়াল রাখেন না। তাঁরা বাচ্চাদেরকে ফাস্ট ফুডে অভ্যস্ত করে ফেলেন। এবং ফাস্ট ফুড গ্রহণের ফলে তাদের শরীরে ক্যালোরির পরিমাণ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। পরবর্তীতে বাচ্চাদের স্থূলতা বৃদ্ধি পায় এবং এই সমস্ত বাচ্চারা ভবিষ্যতে ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে পড়ে যায়, এবং ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা তাদের অনেক বেড়ে যায়৷ কাজেই বাবা মায়ের জন্য পরামর্শ আপনার বাচ্চাকে ফাস্ট ফুড জাতীয় খাবার পরিহার করতে বলবেন। তাঁকে ঘরে তৈরি খাবার দেবেন তাঁকে দৈনিক অন্তত একঘণ্টা মাঠে খেলাধুলা করতে বলবেন। তাহলে এই বাচ্চাটি ভবিষ্যতে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকবে।
এবার আসি বড়দের প্রসঙ্গে, আমাদের কী করা উচিত? প্রথম কথাই হচ্ছে আমি যেটা মনে করি সেটা হচ্ছে আমাদের দৈনিক খাদ্য গ্রহণের যে ব্যাপারটি সেটা সম্পূর্ণ চেঞ্জ করে ফেলতে হবে।কি রকম? আপনাকে মনে রাখতে হবে, যে খাবার খেলে আপনার স্থূলতা বৃদ্ধি পাবে সেগুলো আপনাকে অ্যাভয়েড করতে হবে। তার মধ্যে এক নাম্বার হচ্ছে ফাস্টফুড, পেপসি, আইসক্রিম, চিপস, চকলেট, বার্গার, পেটি, চিকেন ফ্রাই। এগুলো যত কম খাওয়া যায় ততই ভালো। খুব বেশি হলে আপনি মাসে এক দিন খেতে পারেন। তাহলে বেশি কী খাবেন? বেশী বেশী শাক সবজি, ফলমূল, সালাদ, মাছ মাংস খেলেও আপনার ওজন বাড়বে না। আপনার প্লেনটাকে সমান চারভাগে ভাগ করেন। আপনার প্লেটের অর্ধেকটা হবে শাক সবজি, ফলমূল, সালাদ। এক চতুর্থাংশ হবে মাছ, মাংস এবং এক চতুর্থাংশ হবে ভাত বা রুটি। এটা শুধু ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য না।এটা যে কোনও লোক, যে সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে চায়, তাদের প্রত্যেকের জন্যই জরুরি। ডায়াবেটিস হওয়ার আগে যদি আপনি খাদ্যাভাস করেন তাহলে ভবিষ্যতে আপনার ডায়াবেটিস হবে না। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ সেটা হচ্ছে এক্সারসাইজ বা ব্যায়াম। আমরা আধুনিক সভ্যতার যুগে বসবাস করি। এর ফলে এখন যে ঘটনা ঘটেছে সেটা হচ্ছে, আমরা সারাদিন ঘরে অফিসে বসে থাকি এবং আমরা বাইরের জাঙ্ক ফুড বা ফাস্ট ফুড খাই। যার ফলে খুব দ্রুত আমাদের ওজন বেড়ে যায় এবং আমরা সবাই পরবর্তীতে ডায়াবেটিসের শিকার হয়। তাহলে কী করতে হবে? প্রতিদিন মিনিমাম আধা ঘণ্টা প্রতিদিন হাঁটতে হবে। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতিদিন যদি কেউ ১০ মিনিট হাঁটার অভ্যাস করে তাহলে সে বহুলাংশে ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগের ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকে। পাশাপাশি আরও একটি কাজ করতে পারেন, যারা ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে আছে, বা ঝুঁকিপূর্ণ গ্রুপ, তারা বছরে অন্তত একবার ডাক্তারের সাথে দেখা করবেন।
দয়া করে নীতিমালা মেনে মন্তব্য করুন - অন্যথায় আপনার মন্তব্য গ্রহণ করা হবে না।
comment url